প্রযুক্তির এ যুগে স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ছাড়া দিন পার করা বেশ কঠিন। করোনাকালে অনলাইনে ক্লাস করার কারণে শিশুরাও এখন নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। তবে অনেক শিশুই জানে না, অনলাইনে কোন সাইট নিরাপদ, কোনটি নয়। এ জন্য শিশুদের জানতে হবে, অনলাইনে অপরিচিত ব্যক্তি বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ পাঠালে তা গ্রহণ না করাই ভালো।
শিশুদের বুঝতে হবে, নিজের একটু অসচেতনতার কারণে অনলাইনে বিপদ হতে পারে। এ জন্য অনলাইন নিরাপত্তার কৌশল শিখতে হবে ভালোভাবে। কারণ, অনলাইনে অনেক ওয়েবসাইটে বা অ্যাপস ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে। এ ছাড়া বেশির ভাগ সাইবার অপরাধী ভুয়া পরিচয়ে অন্যের তথ্য চুরি করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে। তথ্য চুরির জন্য শিশুদের প্রলুব্ধ করতে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণাও করে তারা।
শিশুদের মনে রাখতে হবে, অনলাইনে অপরিচিত কারও প্রলোভনে পড়ে নিজেদের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া নিজের জন্মতারিখ, ঠিকানা, আর্থিক অবস্থা, এমনকি পরিবারের তথ্যও দেওয়া উচিত নয়।
অনলাইনে নিরাপদ থাকতে অপরিচিত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রবেশ না করার পাশাপাশি লোভনীয় পুরস্কারের প্রলোভনে পাঠানো ই-মেইল বা বার্তা পড়া যাবে না।
একটি বিষয় মনে রাখলে ভালো হয়, ইন্টারনেট ব্যবহারের আগে নিজের মনের অবস্থা কেমন, তা জানতে হবে শিশুদের। কারণ, মন খারাপ বা মানসিক চাপে থাকা অবস্থায় আমরা সাধারণত ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। তাই মন ভালো না থাকলে সামাজিক যোগাযোগের সাইটে বার্তা বিনিময় করা ঠিক হবে না। কারণ, মন ভালো করার কথা বলে পরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি বা ভিডিও সংগ্রহ করতে পারে, যা পরে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সম্মানহানির কারণ হয়।
এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগের সাইটে বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে। প্রয়োজন না হলে সাইটগুলোতে বেশি তথ্য না দেওয়াই ভালো। পাশাপাশি তথ্য নিরাপদে রাখতে সেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত না করে কেবল বন্ধুদের কাছে প্রদর্শন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কখনোই অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে আসা বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা যাবে না। বাস্তব জীবনে যেমন অপরিচিত ব্যক্তিদের থেকে সতর্ক থাকতে হয়, তেমনি অনলাইনেও অপরিচিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সাবধান হতে হবে। এ জন্য ছোটবেলা থেকেই শিশুদের অনলাইনে সতর্ক থাকার কৌশল শিখতে হবে। শিশুদের মনে রাখতে হবে, অপরিচিত কোনো ব্যক্তি অনলাইনে আমন্ত্রণ জানালে বা অশোভন কোনো কাজ করলে অবশ্যই অভিভাবকদের জানাতে হবে।
বাসা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ও ছবি অনলাইনে দেওয়া যাবে না। স্মার্টফোনের জিপিএস–সুবিধা থাকা অনেক অ্যাপ ব্যবহারকারীদের অবস্থানের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। তাই হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোনের লোকেশন ফিচার অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে।
ই–মেইল এবং সামাজিক যোগাযোগের সাইটে অ্যাকাউন্টের জন্য অবশ্যই আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ শব্দ, বাক্য বা ব্যক্তিগত তথ্য যেমন ফোন নম্বর বা পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে পাসওয়ার্ড দেওয়া যাবে না। বড় ও ছোট অক্ষরের সমন্বয়ে কমপক্ষে ১২ সংখ্যার নাম ও পাসওয়ার্ড দিতে হবে। এতে পাসওয়ার্ডের নিরাপত্তা বাড়বে। অনলাইনে পরিচয় হওয়া বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করার সময় অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। পরিচিত স্থান ছাড়া দূরে কোথাও তাদের সঙ্গে দেখা না করাই ভালো। প্রয়োজনে অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আরও একটি সমস্যা শিশুদের না জানলেই নয়, তা হলো ‘সাইবার বুলিং’।
অনলাইনে পরিচিত–অপরিচিত কোনো ব্যক্তি ছবি, ভিডিও বা বার্তা পাঠিয়ে কাউকে হয়রানি বা হুমকি দিলে তা সাইবার বুলিং হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কেউ এমনটি করলে ভেঙে পড়া যাবে না একদম। মনের জোর ঠিক রেখে তাদের পাঠানো ছবি বা বার্তার তথ্য নিয়ে থানায় অভিযোগ করতে হবে। ফলে সাইবার অপরাধীরা তেমন ক্ষতি করতে পারবে না।
অনলাইনে নিরাপদ থাকতে অপরিচিত ওয়েবসাইটে প্রবেশের আগে সেটি ভুয়া কি না, তা যাচাই করতে হবে। সাধারণত, যেসব ওয়েবসাইটের ঠিকানা মজার বা আকর্ষণীয় বলে মনে হয়, তা শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ জন্য ফিশিং স্ক্যাম সম্পর্কে জানতে হবে এবং অপরিচিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আশা ই–মেইল বা সামাজিক নেটওয়ার্ক লিংকে ক্লিক করা থেকে সতর্ক হতে হবে। এতে অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার পাশাপাশি ডিভাইসে ভাইরাসও ঢুকতে পারে।
সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কঠোর হতে হবে অনলাইনে। যতই পরিচিত হোক না কেন, অনলাইনে কখনোই নিজের ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য, ছবি বা ভিডিও বিনিময় করা যাবে না। কারণ, ভবিষ্যতে এসব ছবি বা ভিডিও প্রতারণার কাজে ব্যবহার হতে পারে।
শিশুদের অনলাইনে নিরাপদ রাখার কৌশল শেখাতে বাংলাদেশে নিজেদের অনলাইন সেফটি প্ল্যাটফর্ম ‘ডিজিওয়ার্ল্ড’(https://gpsocial.co/digiworld) চালু করেছে গ্রামীণফোনের মূল প্রতিষ্ঠান টেলিনর গ্রুপ। ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বাংলা ভাষায় তৈরি প্ল্যাটফর্মটিতে খেলার ছলে অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ মিলে থাকে।
এ ছাড়া ইউনিসেফের সহযোগিতায় প্রায় ১০ লাখ শিশুকে অনলাইন নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দিয়েছে সরকার। শুধু তা–ই নয়, ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে কুইজের মাধ্যমে অনলাইনে নিরাপদ থাকার কৌশল শেখার সুযোগ মিলে থাকে।